“মানসম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ভাবনা”
প্রায় প্রত্যেকটি বাবা মায়ের স্বপ্ন-সন্তানরা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকুরী জীবনে পদার্পণ করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই স্বপ্নটা কারো জন্য সুখকর হয় আবার কারো জন্য হতাশা বহন করে। অনেকে পাশ করার পরপরই চাকুরী পেয়ে যাচ্ছে, বেশীরভাগই বেকারত্বের বোঝা বহন করছে।
এর কারণ হচ্ছে-দক্ষ ও মানসম্মত মানব সম্পদ সৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই ব্যর্থ। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুসারে যাত্রা শুরু হয়, উচ্চ শিক্ষাখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ। যার ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চ শিক্ষাখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এর ফলে দেশে অনেক স্নাতকধারী বের হলেও মানসম্পন্ন মানবসম্পদ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে প্রতিবছর যে পরিমাণ স্নাতক বের হন, তার খুব কম সংখ্যকই মানসম্পন্ন।
অনেকে ভালো ফলাফল করলেও চাকুরী পাচ্ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসা বেশীরভাগ স্নাতকদের অবস্থা খুবই করুন। তাদের অনেকে জানে না, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল চাকুরীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। যারা পড়ালেখার পাশাপাশি কারিগরি যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করে, তারাই বেসরকারি চাকুরীর বাজারে কিছুটা এগিয়ে থাকেন। কিন্তু বেশীর ভাগই এ কাজটি করেন না। বেসরকারি খাতে দরকার কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল। কিন্তু আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিতদের সে জ্ঞান না থাকায় তাঁরা চাকরি পাচ্ছেন কম।
সাধারণত, বেসরকারি কারখানায় শ্রমিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের দরকার হয় ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের ৯০ শতাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, যার সঙ্গে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি থাকার আরেকটি কারণ হলো, সমাজে যে ধরনের কাজ পাওয়া যায়, উচ্চশিক্ষিতরা সে ধরনের কাজ করতে আগ্রহী নন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির ক্ষেত্রও কম।
আর তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির জন্য যে ধরনের কারিগরি জ্ঞান দরকার, তা তাঁদের নেই। পাশাপাশি, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যে হারে বাড়ছে, সে হারে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না -এটিও উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ার বড় কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকার অনেক পদক্ষেপ নিলেও কোন সুখকর ফলাফল আসছে না। তাই উচ্চ শিক্ষা শেষেও বেকার থেকে যাচ্ছে তরুণদের একটি অংশ।
বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে ১২তম স্থানে রেখেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। দেশে স্নাতক পাস করা ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার। উন্নয়নের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চ শিক্ষা পরিকল্পনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে সবচেয়ে কঠিন বাঁধাটি অতিক্রম করতে হয় এইচএসসি পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার প্রবেশ মুখে। দীর্ঘ দশ/ বার বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে কি পাবে না, তা নির্ধারিত হয় এ পর্বে। তাছাড়া ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ক্যরিয়ার এ সময়ের নির্ভুল সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করে।
এসব কারণে বহু শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকগণ নানা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এইচএসসি উত্তর সময়টাতে। ভর্তি পরীক্ষার কঠিন যুদ্ধ পার হবার পরেও অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন উচ্চশিক্ষার বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উচ্চশিক্ষার এক একটি বিষয়ের এক এক সময় এক এক মূল্য। সময়ের নিরন্তর ধেয়ে চলার ধারায়-এ মূল্যের উত্থান পতন হয়। এক সময় যে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পছন্দ তালিকার শীর্ষে থাকে সময়ের ব্যবধানে যুগের চাহিদায় সেটিই হয়তোবা নেমে যায় পছন্দ তালিকার একেবারে নিচে।
বর্তমান সময়ে কোন বিষয়ের চাহিদা কেমন, কর্মসংস্থান ও দেশ- সেবার বিস্তৃতি কতদূর, ভবিষ্যত কেমন হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে সকল অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর প্রারম্ভিক ধারণা নেয়া দরকার।ক্যারিয়ার বিষয়ক সিদ্ধান্তের সিংহভাগ গৃহীত হয় ব্যক্তির উচ্চ শিক্ষার উপর ভিত্তি করে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনেক পূর্বেই উচ্চশিক্ষা বিষয়ক ভাবনা শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকের মনে জন্ম নেওয়া দরকার।
এইচএসসি পাশের পূর্বেই অর্থাৎ স্কুল পূর্বেই যদি ‘ক্যারিয়ার: বিকশিত জীবনের দ্বার’ একজন অভিভাবক কিংবা শিক্ষার্থীর হাতে যায় তাহলে এইচএসসি উত্তর উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেটিতে অনেক সুবিধা হবে। ইকোনমিস্ট মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোন খাতে কত শিক্ষার্থী প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে আমরা ব্যর্থ।
কি ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীর চাহিদা রয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম প্রস্তত করা দরকার। তাই, দেশে খাপছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। দুঃখজনক যে, অনেকেই উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম এ শিক্ষার দিকে নজর না দিয়ে ব্যবসা হিসেবে নজর দেয়ায় শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যার ফলে আমরা নিজেদেরকে প্রত্যাশিত দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে পরিচয় দিতে পারি না।
অনেক বেকার তরুণ কোনো কর্মসংস্থান করতে না পেরে অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। মাদকাসক্ত হয়, নানান অপকর্ম করে, সমাজের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হয়। অর্থসংকটের একদিক যেমন বেকারত্ব, তেমনই অপর দিকটা হল আধা বেকারত্ব। আধা বেকারত্ব অর্থাৎ যোগ্যতার চেয়ে নিম্নমানের কাজ বা পার্টটাইম কাজ বা অল্প মাইনের কাজ। প্রধানত উচ্চ শিক্ষিতরাই এই ভিন্ন ধরনের বেকারত্বের শিকার।
দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েও মাসের পর মাস বেকার থাকা, হাজারো আবেদনপত্র পাঠিয়ে মাত্র একটা কি দুটো ইন্টারভিউর ডাক পাওয়া- এ সবই এখন সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক পাঠ্য বিষয় ও বিভাগের ফিরিস্তি আছে, যা দেখলে মনে হয় তারা অন্য জগতে বাস করেন। কারণ নানা ধরনের বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও এগুলি নিয়ে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমন বিষয় ও বিভাগ চালু করতে হবে যাতে পড়াশুনা করে বের হয়ে কাউকে বেকার থাকতে না হয়। যোগ্য ও দক্ষ মানুষ মানেই সম্পদশালী মানুষ।
আর দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে যোগ্য মানুষের বিকল্প নেই।দক্ষতা উন্নয়নে আজকের বিনিয়োগ আগামী দিনের সম্পদ। দক্ষতা না থাকলে ভাল কিছু করা যায় না। অদক্ষরা সমস্যার সমাধান করতে পারে না বরং সমস্যা বাড়ায়। তাই, মানুষ তৈরিতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দরকার এবং সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে আমাদের উচিৎ এমন পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যাতে বাজারের চাহিদানুযায়ী দক্ষ লোক বের হয়। কর্মমুখী ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষায় প্রশিক্ষিত মানুষজন মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠে সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখে।
যে ধরনের শিক্ষিত মানুষ সময়ের দাবি ও যুগের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম, তাদেরকে তৈরি করাই হোক আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । যে শিক্ষিত হবে সে হয় স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল বা উদ্যোক্তা হবে অথবা তার যোগ্যতার কারণেই কর্মসংস্থান করে নিতে পারবে দেশে কিংবা বিদেশে। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র ও সমাজকেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবেই একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতি গঠনের পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
“আবু সুফিয়ান”